“অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমি তব পদধূলি,

ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রাম গুলি”

রূপসী বাংলার রুপে বার বার মোহিত হয়েছেন বাংলার অসংখ্য কবি সাহিত্যিক। তাঁদের কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্পে বার বার অামরা বাংলার অপরূপ রুপের বর্ণনা খুঁজে পাই- বাংলা এককালে কত ছায়া সুনিবিড়, নির্মল, পরিচ্ছন্ন প্রকৃতির আধার ছিল তা অনুমান করা যায়। এখন চারিদিকে তাকালে মন হাহাকার করে ওঠে এক খন্ড সবুজের আশায়। মনে হয় কবি সাহিত্যিকেরা ভুল করে বাংলার প্রকৃতির গুণ কীর্তন করেছিলেন। বর্তমানে বাংলার প্রকৃতিতে দূষণের সমারোহ চলছে, মনে হয় যেন প্রকৃতি ধূলির চাদড়ে ঢেকে আছে। চারিদিকে শুধু দূষণ আর দূষণ। বাংলাদেশের প্রায় সব শহরের বাতাস ভারী হয়ে গেছে সীসা আর কার্বন মনোক্সাইডের মত বিষাক্ত, মারাত্মক, জীবনঘাতি গ্যাসে। মানুষসহ প্রাণিকূল ধীরে ধীরে মৃত্যুর ফাঁদের দিকে এগোচ্ছে। শহরগুলো যতই আধুনিকতার ছোঁয়া পাওয়ায় সাথেই আমরা যেন নির্মল, সবূজ গাছপালা সমৃদ্ধ পরিবেশকে বিদায় জানাচ্ছি।

এত অশান্তির মাঝেও আমাদের মনটা একটু হলেও পুলকিত হয়, আনন্দের ছোঁয়া লাভ করে ২০১৬ সালের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ বা প্রতিবেদনের মাধ্যমে। মনে হয় এ যেন এক অনন্য সাফল্য। হয়ত আমরা স্বর্ণ বা হীরার খনি পায় নি, তবে এই আনন্দ তর থেকে কম ছিল না, বরং বেশিই ছিল। বাংলাদেশের মত একটা জনবহুল, দূষণ সমৃদ্ধ দেশের শহর হয়েও উত্তর বঙ্গের রাজশাহীর কপালে জুটল সেরা দশ পরিচ্ছন্ন নগরীর একটি হওয়ার তকমা। আর বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম তো বটেই। ঐ প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় নিম্ন এবং মধ্য আয়ের অতিরিক্ত জনসংখ্যা বিশিষ্ট দেশ সমুহের মধ্য ৯৮ ভাগ শহর গুলোর পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে কোন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু এক্ষেত্র রাজশাহী মহানগরীর কর্যক্রম নজর কাড়ার মত।

বিশ্ব সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী পি এম ১০ এবং পি এম ২ হল দু’টি বিষাক্ত কণা যা বাতাসে মিশতে পারে। অবশ্য যেসব স্থানে সবুজ গাছের পরিমান কম থাকে, ইটের ভাটা বা কারখানার আধিক্য থাকে কিংবা যানবাহনের পরিমান বেশি থাকে, সেসব স্থানের বাতাসে এই সব কণার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর ঐ দূষিত বাতাস যখন মানব শরীরে প্রবেশ করে তখন মরণঘাতী বিভিন্ন রোগ স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুস ক্যান্সার,  অ্যাজমা ইত্যাদির প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। বাতাসে এইসব বিষাক্ত কণা কঠিন বা গ্যাসীয় অবস্থায় মিশ্রিত থাকে। আর একে বলা হয় পি এম বা পার্টিকেল পলিউশান।

গার্ডিয়ান  পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় যে, রাজশাহী শহরের দূষণ কমার হার সত্যিই আনুকরণ যোগ্য। ২০১৪ সালে রাজশাহীর বাতাসে প্রতি ঘন মিটারে পি এম ১০ কণার পরিমান ছিল ১৯৫ মাইক্রোগ্রাম, যা কিনা মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে তিন ভাগের দুই পরিমান কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৬৩.৯ মাইক্রোগ্রাম। এছাড়াও বাতাসে পি এম ২ এর পরিমানও প্রায় অর্ধেক কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৭ মাইক্রোগ্রামে। উল্লেখ্য, বিশ্বের ১০টি শহরে গত দুই বছরে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমান কমেছে তার মধ্যে রাজশাহীতে কমার হার সব থেকে বেশি।

এবার নজর দেওয়া যাক এই অসাধ্য সাধন প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নের দিকে। সেই পথটাও কন্টকময় এবং পথ চলাটাও ছিল দীর্ঘ। বলতে ৯০ এর দশক থেকেই এই যাত্রা শুরু। মহানগরীতে দূষণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন বৃক্ষ রোপন কর্যক্রম শুরু করে। তারা জিরো সয়েল প্রজেক্ট  হাতে নেয় অর্থাৎ ফুটপাত, রাস্তা ইত্যাদি বাদে যে কোন ফাঁকা জায়গা সবুেজে ভরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাই হলো জিরো সয়েল প্রকল্প। আর এই পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজশাহী মহানগরী হয়ে উঠেছে বিশ্বের দশ শীর্ষ দূষণ মুক্ত নগরীর একটি। এই প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে সবুজ হয়েছে শহরের প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তার সড়ক বিভাজক ও সড়ক দ্বীপ। ধীরে ধীরে শহরের সমগ্র সড়ক বিভাজক, সড়ক দ্বীপ এর আওতায় আনা হবে। নগরীর প্রধান সড়ক বিভাজক ও সড়ক দ্বীপে আছে ৩৫০ টি পাম ট্রি যাদের মধ্যকার দূরত্ব ২০ ফুট। মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় লাগানো হয়েছে- রঙ্গন, চেরি, কাঠ করবী ও এ্যালামুন্ডা। সবার নিচে রয়েছে সুজ হেজ। এসব গাছের দেখভালের দায়িত্বে আছে প্রায় অর্ধ শত শ্রমিক। আর নগর পরিকল্পনাবিদরা বিশ্বের আধুনিক শহর ভ্রমনের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এখানে তার বাস্তবায়ন ঘটান। সকলের আন্তরিকতায় রাজশাহী নগরী ধীরে ধীরে গ্রিন সিটি হিসাবে পরিচিতি এবং মর্যাদা পেয়েছে।

রাজশাহী নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং মডেল নগরী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য আরও কিছু বাস্তব পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সেগুলো হল:-

. জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে।

. আধুনিক পয়:নিস্কাষন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।

. নগরীর অতি সন্নিকটে গড়ে ওঠা ইট ভাটাগুলো সরিয়ে ফেলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।

. মূল রাস্তাসহ অলিগলির সকল রাস্তার উন্নয়ন করা এবং পরিচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে।

.  ফুটপাতগুলোতে টাইলস বসানো হয়েছে।

.  নির্মান সামগ্রী এখন আর রাস্তায় ফেলে রাখা হয় না।

. পেট্রোল, ডিজেল চালিত যানবাহন-মিশুক, ভটভটি, টেম্পুর সংখ্যা শহরে এখন অনেক কম।

.  শহর পরিচ্ছন্ন করার সময় সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে সকালে করা হত, এখন রাতে করা হয়।

. পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে বালুর ব্যবসা করার পয়েন্ট গুলোতে পার্ক নির্মান করা হয়েছে।

.  পদ্মার বাঁধের কোল ঘেঁষে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাছ এবং ঘাস।

.  রাজশাহী শহরের চার পাশে সবুজ বেষ্টনী সৃষ্টি করা হয়েছে।

এভাবে রাজশাহী শহরকে একটি বসবাস উপযোগী দূষণ মুক্ত শহরে পরিনত করার জন্য সব দিক থেকে পরিকল্পনা মাফিক জোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। যা এখনও অব্যাহত আছে। এসব কাজের সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরুপ রাসিকের ভাগ্যে বেশ কয়েক বার প্রধানমন্ত্রীর পদক প্রাপ্তির সুযোগ ঘটেছে। ২০১২ সাল থেকে চালু হওয়া পরিবেশ পদক প্রাপ্তির ক্ষেত্রও রাসিক-ই সেরা।

পরিবেশবিদরা মনে করছেন অতীতের তুলনায় রাজশাহীতে বৃষ্টিপাতের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে ফাঁকা জায়গাগুলোতে ঘাসের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ইট ভাঁটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করত। গাছপালার সালোকসংশ্লেষনের হার কমিয়ে দিত। এই পরস্থিতি এখন অনেকটা সামলানো গেছে। বায়ু দূষণের হার কমেছে। বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমান বেড়েছে। এখন ধূলি ঝড়ও খুব একটা দেখা যায় না; ১৯৮০-৯০ সালে যা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। সব বাধা পেরিয়ে রাজশাহী এখন গ্রীন সিটি বা সবুজ শহর- বাংলাদেশের গর্ব।

Link1 | Link2