রাজশাহী বড়কুঠি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বড়কুঠি। বলা হয়ে থাকে যে, বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ এর রাজশাহী অঞ্চলের সবথেকে প্রাচীন ইমারত হলো এই বড়কুঠি। রাজশাহী শহরের সাহেব বাজারে অবস্থিত এ দোতলা বিল্ডিংটির সার্বিক নির্মাণকাল জানা যায় নি তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করে থাকেন যে ভবনটি অষ্টাদশ শতাব্দী এর প্রথমার্ধে নির্মাণ করা হয়। বাংলায় ব্রিটিশ শাসনামলের পূর্বে নির্মিত এই দালানটির প্রতিটি কোণায় জড়িয়ে আছে ইতিহাস। ডাচ বণিকদের কুঠি নির্মাণ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত রাজশাহী শহরের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ দোতলা কুঠিটি।
ইতিহাস ও পরিচয়ঃ
অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ কুঠিটি নির্মাণ করে ডাচ বণিকরা। ভবনটি ছিল ডাচদের ব্যবসা কেন্দ্র। তবে, ডাচরা ভারতে এ ব্যবসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলে ১৮১৪ সালে বড়কুঠি ইংরেজদের কাছে হস্তান্তর করে। এটি ব্রিটিশদের বাণিজ্যকুঠি হিসেবে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়। প্রথম দিকে, ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলা শাসন করা শুরু করে। তখন থেকে বাংলা তথা গোটা ভারতবর্ষ এ ইংরেজদের আধিপত্য শুরু হয়। বড়কুঠি ও ইংরেজরা ডাচদের কাছ থেকে ক্রয় করে নেয়। তখন, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বড়কুঠি কিনে নিলে, কোম্পানির একজন প্রতিনিধি এখানে ব্যবসা করা শুরু করে। তখন, রাজশাহী অঞ্চলের রেশম ইউরোপ এর বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা হত। এ রপ্তানিকার্য এর সর্বাদিক দেখভাল করা হত বড়কুঠি থেকে। কিন্তু, রেশম এর ব্যবসা না হলেও নীল বিদ্রোহ শুরু হলে, নীল চাষ শুরু করা হয় এ অঞ্চলে। নীল উৎপাদনের কৌশল আবিষ্কার হবার পর ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এ কুঠিটি অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবার পরে, এর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় বড়কুঠি।
অবস্থানঃ
রাজশাহী শহরের সাহেববাজারে অবস্থিত এ বড়কুঠি। যার উত্তরে রাজশাহী কলেজ এবং দক্ষিণে পদ্মা নদী অবস্থিত। পদ্মাপাড়ের মনোরম পরিবেশে অবস্থিত এ কুঠি আজ দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। বর্তমানে, এখানে একটি বিনোদন পার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বড়কুঠি এর অবকাঠামোঃ
দালানটি ২ তালা বিশিষ্ট একটি স্থাপনা যা প্রায় ২৪ মিটার দীর্ঘ এবং প্রায় ১৮ মিঃ প্রশস্ত। নিচতলায় ও উপরতলায় ৬টি করে মোট ১২ টি কক্ষ আছে এ দালানটি তে। একমাত্র সভাকক্ষটি দোতলায়। নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে তৎকালীন সময়ে ভবন এর গায়ে করা হয় অসংখ্য ছিদ্র যা থেকে গুলি ছোড়া সম্ভব। ভবনটির উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি করে বারান্দা।
বড়কুঠি এর ব্যবহারঃ
ওলন্দাজ বা ডাচদের হাতে যখন ভবনটি ছিল তখন ভবনটি ঘিরে ছিল ব্যাপক নিরাপত্তা। তখন, রেশম এর গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হত এ কুঠি যার নিচতলায় রাখা হত গোলা বারুদ। পরবর্তীতে, ব্রিটিশদের হাতে হস্তান্তরিত হবার পরে দালানটি ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে ইংরেজ কম্পানির বন্দিশালা হিসেবে। নীল চাষ করতে অস্বীকৃতি জানানো কৃষকদের এখানে ধরে এনে নির্যাতন করা হত এবং বন্দি করে রাখা হত। সিপাহী বিপ্লবের সময়ে এ কুঠিটি ব্যবহৃত হয়েছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হেডকোয়ার্টার হিসেবে। এ ভবন থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা রাজবাড়ি পর্যন্ত গুপ্ত সিড়ি আছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।
রাজশাহী শহরের ঐতিহ্যবাহী এ স্থাপনাটি ব্রিটিশ শাসনামল এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ইতিহাস এর সাক্ষী হয়ে আছে। নীল বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের অত্যাচার, সে সময় এর সাহেব বাজারের দৈনিক ব্যস্ততা, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশ এর সূচনা সূচনা ও পতন, সবকিছুরই সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দালানটি। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে এ অঞ্চলের উন্নতি, জনজীবনের দুর্ভোগ, ঐতিহাসিক সিপাহি বিপ্লব সহ সকল ইতিহাস যেন অদৃশ্য এক কালি দিয়ে বড়কুঠির প্রতিটি ইউ লেখা আছে। বেশ কয়েকবার ভূমিকম্পের ফলে, দালানটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশ কয়েকবার পুনঃমেরামত করা হয় ভবনটি। বর্তমানে এ স্থাপনা কে সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পর্যটন স্থাপনার পাশাপাশি একে একটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নির্মাণ হবে পার্ক যার জন্য বিদেশী কম্পানির সাথে চুক্তি ও করা হয়েছিল। পরিশেষে এ স্থাপনা সম্পর্কে বলা যায়, উত্তরবঙ্গে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অন্যতম স্বাক্ষী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এ দালানটি যা রাজশাহীর বড়কুঠি নামে সর্বজনে পরিচিত।