বর্তমানে রাজশাহী বলতে রাজশাহী জেলা,রাজশাহী বিভাগ এবং মহানগর রাজশাহীকেই বুঝানো হয়।১৯৪৭ সালের পূর্বে কিংবা তারও অনেক পূর্বে অর্থ্যাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে ঠিক এমনটি ছিলনা। রাজশাহী নামটি সপ্তাদশ শতাব্দীতে শোনা যায়নি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সর্বপ্রথম নামটির সাথে আমরা পরিচিত হই।
মুর্শিদকুলী খান ১৭০১ সালে বাংলা এবং উড়িষ্যার দেওয়ান পদে আসীন হলে নতুন রাজস্ব বন্দোবস্তের আওতায় ২৫টি জমিদারী বিভাগের প্রথমটি হচ্ছে বর্দ্ধমান। দ্বিতীয় জমিদারীর নামকরণ রাজশাহী করা হলো প্রথম ইতিহাসে রাজশাহীর নাম আসে।
‘রাজা’ এবং ‘শাহী’ এই দুটো শব্দের সংযোগে রাজশাহী নামের উদ্ভব ঘটেছে। ‘রাজা’ শব্দটি সংস্কৃত এবং হিন্দী ভাষায় একই অর্থ বহন করে। ‘শাহ’ শব্দটি পারসী ভাষা থেকে এসেছে যেটি হিন্দী ও সংস্কৃত ভাষার ‘রাজা’ শব্দটির সাথে একই অর্থ জ্ঞাপক। এভাবেই রাজা থেকে রাজ এবং শাহ থেকে শাহী শব্দ দুটি একত্রি হয়ে হয়েছে ‘‘রাজশাহী”। রাজশাহী অঞ্চলে বহু জমিদার এবং রাজাতুল্য জমিদারের বসবাস ছিল। পাল ও সেন রাজাদের রাজত্ব ছিল এই অঞ্চলে। পরবর্তীকালে শাহ সুলতানদের রাজত্ব এবং শাহ ফকির দরবেশগণের আগমন ঘটেছে রাজশাহীর মাটিতে ব্যাপকভাবে। একারণে রাজা এবং শাহ এই দুটি শব্দের সাথে ঐতিহাসিক ভাবেই এলাকার যোগসূত্র রয়ে গেছে যুগ যুগ ধরে।
শহর হিসেবে রাজশাহী নামটি এসেছে সর্বশেষে। বর্তমান রাজশাহী শহরটির প্রাচীন নাম মহাকালগড়। রাজশাহী শহরের এখনকার এলাকা পূর্বের লস্করপুর এবং গড়ানহাটি পরগনার অধীন ছিল। শহরের দরগাহ পাড়া সহ মাস্টার পাড়া, কলেজ, হোসেনীগঞ্জ এবং পাঠানপাড়ার একাংশ ‘মহাকালগড়’ নামে পরিচিত ছিল। যতদূর জানা যায় ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্বে মহাকালগড়ের আশেপাশে কোন জনবসতি গড়ে উঠেনি। পদ্মা থেকে উৎপত্তি লাভ করে কয়েকটি নদী এবং খাল দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত হতো। তখনও মূল শহরটি পদ্মার প্লাবন ভূমি হিসেবেই ভূমি গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছিল। এমনি একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষনে হযরত তুরকান শাহ, শাহ মখদুম রূপোশ (রহ:) সহ বেশ কয়েকজন সূফী দরবেশগণের আগমন ঘটে এই জনপদে। সুফী দরবেশগণ ধর্মের বাণী প্রচারের পর পরলোকগমন করলে অগণিত ভক্তবৃন্দ মহাকালগড় নামক জনপদটির নতুন নামকরণ করলেন বুয়ালিয়া। পারসী ‘বু’ অর্থ সুবাস। অর্থ্যাৎ আউলিয়াগনের সুবাসিত স্থান। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক অবধি শহরের নাম ছিল বুয়ালিয়া।
১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে যখন নাটোর থেকে জেলা সদর দপ্তর বুয়ালিয়াতে স্থানান্তরিত হয়েছিল, এরপর থেকেই শহরটির নতুন নাম হলো রামপুর বোয়ালিয়া। রামপুর বোয়ালিয়া নামটি ১৯৪৭ সাল অবধি সরকারিভাবে প্রচলিত ছিল। শহর হিসেবে রাজশাহী নামটি প্রথম লক্ষ্য করা গেছে রেলস্টেশনের নামকরণের মধ্য দিয়ে। ১৯২৯ সালে রেলস্টেশন চালু হলে এর নাম ছিল রামপুর বোয়ালিয়া। সামান্য কিছুদিন পরেই নাম বদলে রাজসাহী রাখা হয়। এরপর ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের কবল থেকে দেশ মুক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর স্টেশনের নাম হয় রাজশাহী। এর পূর্বে পোষ্টাল ডিপার্টমেন্ট রামপুর বোয়ালিয়ার পরিবর্তে শহরকে রাজশাহী নামে অভিহিত করেছেন। ১৯৪৭ সালের পর থেকে শহরটি রাজশাহী নামে পরিচিত।
(সূত্রঃ শহর রাজশাহীর আদিপর্ব, মাহবুব সিদ্দিকী)