নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ সাড়ে চার লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম, এক কোটি শরনার্থীর হাহাকার, লক্ষ লক্ষ গৃহ হীন মানুষের আহাজারি- এ সবের বিনিময়েই পেয়েছি আমাদের বাংলা মাকে। স্বাধীনতার মূল্যটা নিতান্ত কম নয়, বরং একটু বেশিই। এই রকম গর্বিত শোকাবহ ইতিহাস খুব কম জাতির আছে। আমরাই ইতিহসের দাবিদার। সালটা ১৯৭১, বাংলাদেশের মানুষ পার করছিল এক ভয়াবহ দু:সহ সময়। চারিদিকে যুদ্ধের দামামা, বাংলার মানুষের তখন ভয়, শঙ্কা আর বুকে বাংলা মায়ের প্রতি ভালোবাসা, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা, চোখে মুক্তির স্বপ্ন। ঠিক এই অপরাধেই হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের ঠিকানা হয়েছিল গণকবর কিংবা ব্যভূমিতে। সইতে হয়েছিল অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন। সব থেকে বড় কথা মৃত্যুর তারা পায়নি এক টুকরো কাফনের কাপড়, তাদের দাফনের জন্য বরাদ্দ হয়নি এক খন্ড জমিনও। অমানবিক নির্যাতনের ফলে তাদের মৃত্যু পর মৃত দেহ গুলো ফেলে দেওয়া হত কোন ভাগাড়ে, ডোবাতে, নিচু ভূমিতে বা গর্তে। শিয়াল, কুকুর, শকুনে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়েছে তাদের মৃতদেহ গুলো। কখনও কখনও অর্ধমৃত বা জীবন্ত মানুষদেরও একসাথে একটা গর্তে নামিয়ে দিয়ে মাটি কিংবা বালু চাপা দিয়ে দেওয়া হত। এমনকি এসব ভাগ্যহত মানুষদের স্বজনরা জানতেনও না তাদের প্রিয়জনদের করুণ দশা সম্পর্কে। তারপর ১৬-ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আবিষ্কৃত হতে থাকে এই সব গণকবর বা বদ্ধভূমি।

৭১-এর স্বজন হারা মানুষেরা পাগলপ্রায় হয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন তাদের প্রিয় মানুষ গুলোর সন্ধানে। কোথাও কোন গণকবর আবিষ্কৃত হলেই সাথে সাথেই ছুটে গেছেন, সেই সব পচা, গলিত ও অর্ধ বিকৃত লাশের সঙ্গে থাকা জামা-কাপড়, ঘড়ি, আংটি, কিংবা শরীরের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সথে মিলিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেছেন তাদের প্রিয়জনদের। এটা সত্যি হৃদয় বিদারক, মর্মান্তিক। বুদ্ধিজীবি, সমাজসেবী, ব্যবসায়ী, এমন কী  সাধারণ মানুষও বাদ পড়েনি। একমাত্র বাঙালী হওয়াই তাদের অপরাধ।

স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সারা দেশে ছোট বড় অসংখ্য গণকবর বা বদ্ধভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুধপাড়া বদ্ধভূমি) বদ্ধভূমি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত বদ্ধভূমি গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা মিলে রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য নর-নারীদের ধরে নিয় আসে এবং নৃশংসভাবে হত্যা করে পুঁতে রাখে এই বদ্ধভূমিতে। বিজয়ের পর ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এই বদ্ধ ভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। ঐ বদ্ধভূমি থেকে উদ্ধার করা হয় কয়েকশ মাথার খুলি, হাড় ও কঙ্কাল।

১৯৭১ সালের ১৩-ই এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে তাদের ক্যাম্প বা নির্যাতন কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। পাক সেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলকে টানা নয় মাস ক্যান্টনমেন্ট হিসাবে ব্যবহার করেছিল। এই হলের ঠিক পিছনে প্রায় এক বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে এই বদ্ধভূমির অবস্থান। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্থানীয় জনগনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যায় বিভিন্ন এলাকা থেকে হাত পা বেঁধে অসংখ্য নারী পুরুষদের তুলে এনে রাখা হত জোহা হলে। তারপর নির্যাতন কেন্দ্রে অমানুষিক  নির্যাতন করে মৃত, অর্ধমৃত কিংবা জীবন্ত অবস্থায় হলের পিছনে গর্ত সদৃশ নিচু একটা জায়গায় ফেলে দিত। স্বাধীনতার পর এই বদ্ধভূমি থেকে যেসব হাড়গোড় পাওয়া গিয়েছিল সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহ শালার তিনটি আলমিরাতে সংরক্ষিত আছে। ঐ নির্দিষ্ট জায়গাটিতে পরে স্থাপন করা হয়েছ বিশ্ববিদ্যালয়ের বদ্ধভূমি স্মৃতি স্তম্ভ।

এখন শোনা যাক এক প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগীর কথ। ১৬-ই অক্টোবর, ১৯৭১। ভোর রাত। তুলে অনা হয় নগরীর বালিয়াপুকুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মান্নান সরকারকে। তখন তার বয়স মাত্র ২১। ফেলে রাখা হয় জোহা হলের দোতলার একটি ঘরে। প্রথমে তিনি বুঝতে পারেননি কোথায় আছেন। পরে সেখানকার বন্দীদের কাছ থেকে জানতে পরেন। এবার আসা যাক পাক সেনাদের খেদমতের কথায়। প্লাস দিয়ে তার হাত পায়ের নখ গুলো তুলে ফেলার চেষ্টা করা হয়, সেই বিভৎস ক্ষত এখনও তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। তার এক আত্মীয় মীর রহমত আলীকেও তার সাথে তুলে আনা হয়েছিল। বেয়নেট দিয়ে তার চোখ উঠিয়ে ফেলেছিল বর্বর পাক সেনারা। পরে তার কী হয়েছিল সে ব্যাপারে আব্দুল মান্নান কিছুই জানেন না। তার দেওয়া তথ্য মতে তাকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেই ঘরের মেঝে মানুষের রক্তে প্রায় দুই ইঞ্চি পরিমান পুরু হয়েছিল। রক্তের ভ্যাপসা গন্ধে শ্বাস-প্রশ্বাসও কষ্টকর ছিল। তিনি আরও জানান, ২১ অক্টোবর রাতে ক্যাম্পের নিচতলার একটি ঘরে মেজরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধদের সম্পর্কে তথ্য দিতে না পারায় চলে প্রচন্ড নির্যাতন। এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে আবিষ্কার করেন লাশের স্তুপের মাঝে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ের একেবারে পশ্চিমে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের পাশেই অবস্থান এই বদ্ধভূমির। বদ্ধভূমি স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মানের জন্য বিশ্ববিদ্যলয়ের উপচার্য ড: আব্দুল খালেক ১৯৯৮ সালে সরকারের নিকট সুপারিশ করেন। পরবর্তী উপচার্য প্রফেসর এম সাইদুর রহমান খান ১৯৯৯ সালের ১৬-ই ডিসেম্বর এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মান করেন। এর নির্মান খরচ ছিল আড়াই কোটি টাকা। প্রথম স্তরটি নির্মান খরচ ছিল ৮৪ লক্ষ টাকা। সিমেন্ট দ্বারা তৈরি গোলাকার বেদির উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ যার উচ্চতা ৪২ ফুট। এটি সমতল ভূমির উপর দন্ডায়মান। ২০০৪ সালের ২১শে ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করা হয়। স্মৃতিস্তম্ভটি বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালর অন্তর্ভূক্ত। এখানে রয়েছে একটি স্মৃতি ফলক, যাতে লেখা আছে “১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঘাতক পাকিস্তানি বাহীনির হাতে যাঁর প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই সব মৃত্যুহীন শহীদ এই গণকবরে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।” বাঙালী জাতি তাঁদের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।

বধ্যভূমির পাশেই রয়েছে নির্মল শান্তির প্রতীক বটগাছ, যা বদ্ধভূমির নিরবতাকে যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহীনির কয়েকজন সদস্য এর নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। চারিদিকে সুনসান নিরাবতা। স্মৃতিস্তম্ভটির চারিপাশে বটলব্রাশের সারি। ফুলের বাগানে শোভা পাচ্ছে- গাঁদা, নয়নতারা, করবী, ফায়ারবল, সালভিয়া ইত্যাদি ফুলের গাছ।

যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিননি, তারা হয়তো ভাবতেও পারবেন না ১৯৭১ সালে এই স্থান টি কত বিভৎস ছিল! সচেতন মহলের ধারনা এই  বদ্ধভূমিতে পরিকল্পিত ভাবে খনন কজ চালানো হয় নি। এই বদ্ধভূমিতে কতজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তারও কোন সঠিক হিসাব নাই। তবে সব কিছুর উপরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বদ্ধভূমি গুলোর মধ্যে একটি, যেখানে গেলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয় এং গর্বে বুক ভরে যায়।