রাজশাহী রাজ ছিল বাংলার সুবাহদার মুর্শিদকুলী খানের সময় (১৭০৪-১৭২৭) বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদার। তাঁর দৃঢ় শাসন ও কঠোর নিয়মানুবর্তী রাজস্বনীতির ফলে অনেক বনেদি জমিদার ত্রুটিপূর্ণ জমিদারি শাসন, যথাসময়ে সরকারি রাজস্ব প্রেরণে ব্যর্থতা এবং অবাধ্যতা ও বিদ্রোহের কারণে তাদের জমিদারি হারায়। নওয়াব মুর্শিদকুলী খান এ সকল জমিদারি তাঁর অভিজ্ঞ কর্মচারী এবং প্রিয় ও বিশ্বস্ত অনুচরদের মধ্যে নতুন করে ইজারা দেন। এতে সবচেয়ে লাভবান হয় রাজশাহী জমিদারি (নাটোর রাজ)। নওয়াবের এ নীতির উদ্দেশ্য ছিল বৃহৎ জমিদারি সৃষ্টি।

মুর্শিদকুলী খানের বিশ্বাসভাজন হিসেবে রঘুনন্দন ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভাই রামজীবনের নামে রাজশাহী জমিদারির একাংশ লাভ করেন। পরবর্তীতে বানুগাছির জমিদার, ভাটুরিয়া পরগনা ও নিজ-রাজশাহী, নলদী পরগনাও রামজীবনের অধীনে ন্যস্ত হয়। ভূষণার জমিদার সীতারাম বিদ্রোহী হয়ে উঠলে এবং সদরে রাজস্ব পাঠানো বন্ধ করলে মুর্শিদকুলী খান তাঁর বিরুদ্ধেঅভিযান প্রেরণ করেন যাতে সাহায্য করেছিলেন রামজীবন। এ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ মুর্শিদকুলী ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে ইব্রাহিমপুর পরগনা সহ সমগ্র ভূষণা রামজীবনকে প্রদান করেন। বিদ্রোহী আফগান দলপতিদের দমন করে টাকি সরুবপুরের জমিদারিও সংযোজিত হয় রামজিবনের জমিদারিতে। এভাবে রামজীবন তাঁর দক্ষ জমিদারি পরিচালনা ও নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করে নওয়াবের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠে। এভাবে রাজশাহী জমিদারি এর প্রতিষ্ঠাতাদের জীবনকালেই বিশাল আকার ধারণ করে বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারিতে পরিণত হয়।

রঘুনন্দনকে রাজশাহী জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা বলা হলেও, প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাঁর বড় ভাই রামজীবন। তাঁদের কোন উত্তরাধিকারী ছিল না। রামজীবনের দত্তক পুত্র রামকান্ত রাজশাহীর জমিদারি অধিকারী হন। কিন্তু তিনি অধিকাংশ সময় ধর্মীয় কাজে ব্যস্ততা ও জমিদারি পরিচালনায় অবহেলা অনভিজ্ঞতার কারনে জমিদারির হাল ধরেন তাঁর বিচক্ষণ স্ত্রী রাণী ভবানী। ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে রামকান্তের মৃত্যু পর রাণী ভবানী রাজশাহী জমিদারির সমুদয় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন। তিনি মুর্শিদাবাদের নওয়াবের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসন ভার গ্রহণ করলে রাজশাহী জমিদারির সমৃদ্ধি দেখে রাণী ভবানীকে জমিদারি পদে বহাল রাখেন।

১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাণী ভবানী তাঁর দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণকে জমিদারি হস্তান্তর করেন। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সাথে দশসনা বন্দোবস্ত হয়। এর পর থেকে উচ্চহারে রাজস্ব নির্ধারণ, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং কর্মচারীদের ষড়যন্ত্রে রাজশাহী জমিদারিতে ভাঙন শুরু হয়। অল্প কয়েকটি পরগনা ছাড়া গোটা জমিদারি নতুন নতুন মালিকদের নিকট হস্তান্তরিত হয়। সে সময় রাজশাহী জমিদারির দশসনা বন্দোবস্তে সরকারকে দেয়া রাজস্ব, প্রজাদের কাছ থেকে বাস্তব আদায় করা রাজস্বের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। তাই বছর বছর বেড়ে যাচ্ছিল বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ।

১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা বিশ্বনাথ জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলে, বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করার জন্য তাঁকে মহলের পর মহল বিক্রি করতে হয়। ১৮০০ সালের মধ্যে বিশাল রাজশাহী জমিদারি এর সকল মর্যাদা ও গুরুত্ব হারায়। চরম আর্থিক অনটনের কবলে পড়লে জমিদারের অতীত গৌরব ও মর্যাদা এবং বর্তমান দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে সরকার তাঁকে ১৮০৫ সাল থেকে ৮০০ টাকা মাসিক বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করে।

জমিদারি ধ্বংস হওয়ার পেছনে অধিক রাজস্ব নির্ধারণই শুধু একমাত্র কারণ ছিল না। এ ব্যাপারে রাজার ব্যক্তি চরিত্রও যথেষ্ট দায়ী ছিল। বৈষ্ণব মতবাদে বিশ্বাসী রাজা রামকৃষ্ণ জমিদারি সেরেস্তার কাজকর্ম ভুলে প্রায় সারাক্ষণ ধর্মকর্ম ও দান-ধ্যানে ব্যাস্ত থাকতেন। জমিদারি ব্যবস্থাপনায় রাজার চরম উদাসীনতা তাঁকে পরিপূর্ণ ভাবে আমলাদের উপর নির্ভরশীল করে তোলে। কালক্রমে এরা এত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে, রাজা তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।

প্রায় সমগ্র আঠারো শতক জুড়ে রাজশাহী রাজপরিবারের উত্থান ঘটে, তবে এর পতনও শুরু হয় শতক শেষ হওয়ার আগেই। পরবর্তী শতকে পরিবারটি কোনক্রমে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। অবশেষে ১৯৫০ সালের ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট (East Bengal State Acquisition and Tenancy Act) অনুযায়ী এই জমিদারি বিলুপ্ত হয়।

[সূত্রঃ এ.বি.এম মাহমুদ এবং সিরাজুল ইসলাম, বাংলাপিডিয়া]