পদ্মার ভাঙ্গাগড়ার সাথে রাজশাহী শহরের ভাগ্য জড়িত। প্রায় পঞ্চদশ শতকে এ শহরের দক্ষিনে দুই থেকে আড়াই মাইল দূর দিয়ে মহানন্দা নদী পশ্চিম থেকে দক্ষিনে প্রবাহিত হত। এ সময়ে মহানন্দার ৩/৪ মাইল দক্ষিনে পদ্মা প্রবল ছিল। পরে পদ্মা বাম দিকে সরে এসে মহানন্দাকে গ্রাস করে ফেলে।
প্রকৃতির তাড়নায় বান-বন্যায় ভরা যৌবনোদ্দম এই রাক্ষসী পদ্মা বহুবার পথ পরিবর্তন করে বহু পুরাতন বাজার-বন্দর, বৃক্ষ শোভিত গ্রাম, শস্য-শ্যামল মাঠ প্রান্তর, বহু মসজিদ-মন্দির, দালান-কোঠা প্রভৃতি কত কীর্তি যে ধ্বংস করেছে তার ইয়ত্তা নাই। রাজশাহীর পুরাতন বর্দ্ধিষ্ণু গ্রাম চর সাঁইপাড়া, কাদিরপুর, শ্রীরামপুর, সাহেবগঞ্জ, নবীনগর, হাবাসপুর, নওয়াবগঞ্জ-বাজার, বাশরী প্রভৃতি গ্রাম পদ্মা গর্ভে সমাধিস্থ হয়েছে। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজশাহীর শ্রীরামপুরে অবস্থিত জেলার সরকারী দপ্তরখানা, ইউরোপিয়ান্দের আবাসিক কুঠি, সাহেবগঞ্জ প্রভৃতি নদীগর্ভে নিমজ্জিত হলে টাউনস্থ সরকারী বেসরকারী লোকজন বহু ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জন সাধারণরা ভীত হয়ে উঠে। অতপর বাধ দিয়ে শহরকে রক্ষা করা সাব্যস্ত হয়। জেলার সদর-কোট-কাচারী প্রভৃতি বুলনপুরে স্থানান্তরিত হলে কাচারীর দক্ষিণে, বুলনপুরের দক্ষিণ ধার দিয়ে ইং ১৮৫৫ সালে সর্বপ্রথম বাঁধ নির্ম্মিত হয়। এটাই রাজশাহীর প্রথম সরকারী বাঁধ। তারপর বন্যার সময় কখন কখন কাচারী প্রাঙ্গণে বন্যার পানি প্রবেশ করতে থকলে কাচারী সংলগ্ন পশ্চিম ও দক্ষিণ ধারে ঢালু করে আর একটা বাঁধ নির্ম্মিত হয়। সরকারী কাগজপত্রে এ বাঁধটি ১৮৫৫ ইং এর বাঁধ বলে উল্লেখ আছে।
১৮৬৯ ইং সালে বর্ষার সময় প্রলয় বন্যায় পদ্মা পুনরায় তার প্রলয় গতিবেগ নিয়ে রামপুরা-বুয়ালিয়াস্থিত শহর এবং নিকটস্থ আরও কয়েকটি স্থান আক্রমণ করে। তখন বুয়ালিয়া তালাইমারী ও গোদাগাড়ী রোডে বাঁধ দেওয়ার বিষয় স্থির হয়। তদনুযায়ী ১৮৯৫ ইং সালে গোদাগাড়ী রোড বাঁধ, বুয়ালিয়া বাঁধ ও তালাইমারী বাঁধ তৈরী হয়। ১৯৪৪ সালে পাঠানপাড়া বাঁধ এবং দরগাপাড়া বাঁধ তৈরী হয়। অতঃপর ১৯৪৮-৪৯ ও ১৯৫৪ সালে আরও দুইটি বাঁধ নির্ম্মিত হয়। এগুলো হল সোনাইকান্দী-কাজলা বাঁধ এবং কাজলা বাঁধ। এটাই রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধ নির্মণের মোটামুটি ইতিকথা। এখানে একটি মজার ব্যাপার এই যে, স্থানীয় প্রাচীন লোকের মুখে বর্তমান বাঁধের নীচে আরও কয়েকটি বাঁধের কথা শোনা যায়। কিন্তু সরকারী কাগজপত্র তার কোনো উল্লেখ নাই।
জমিদারী আমলে বুয়ালিয়ার বহু অঞ্চল এবং নদীর চরগুলি রাজশাহীর রাজা জমিদারদের খাস মহলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সব চরে নীল ও রেশমের প্রচুর চাষ হত। পদ্মার বন্যার সময় এই চরগুলোর শস্যাদি রক্ষাকল্পে জমিদারগণ তখন নিজ নিজ এলাকায় প্রতি বৎসর বাঁধ বেধে দিতেন এবং এজন্য প্রজাদিগকে পৃথক কর দিতে হত; জমিদারী কাগজ পত্রে উহার উল্লেখ আছে। তাই সরকারী বাঁধের পূর্বে পদ্মার চরে যে জমিদারী বাঁধ ছিল একথা সত্য। তবে বর্তমান সরকারী বাঁধের নীচে আরও কয়েকটি বাঁধ নদী গর্ভে নিমজ্জিত হয়েছে।
(সূত্রঃ রাজশাহীর ইতিহাস, কাজী মোহাম্মদ মিছের)