শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে অথাপি মানুষের মনে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে জাগরুক রাখতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আমরা দেখতে পাই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধকে মহিমান্বিত করার জন্য ভাস্কর্যগুলো সমহিমায় বিরাজমান। ভাস্কর্য গুলো জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সরকারি স্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে নির্মিত হয়েছে। ১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শিল্পী নিতুন কুন্ডূ নির্মিত “সাবস বাংলাদেশ” একটি দৃষ্টিন্দন ভাস্কর্য। এটি এমনি একটি প্রতীকি ভাস্কর্য, যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে আংশ গ্রহনকারী তরুনদের দেশপ্রেম, সরলতা, গতিময়তা, এবং মুক্তিযুদ্ধের তেজস্বী ভাব প্রকাশ পেয়েছে। নির্মানশৈলী এবং নান্দনিকতায় ভাস্কর্যটি অনবদ্য।
তাৎপর্যঃ
স্বাধীনতার স্মৃতিকে চির অম্লান রাখতে, এবং এর আভাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী তথা আগত সকল দর্শনার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে স্থাপন করা হয় এই স্মৃতি ভাস্কর্যটি। বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রী ও শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পদচারনা রয়েছে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষকদের অংশগ্রহন ছিল বলিষ্ঠ ও সাহসী। তখন ঘটনা প্রবাহ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, যার মাধ্যমে গণআন্দোলনের প্রবল স্রোত ছিল সারা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়েই। এই আন্দোলনে অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা শাহাদাৎ বরণ করেন। এর পর ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালী জাতির অস্তিত্ব এবং বাংলাদেশের নাম পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার যে ঘৃন্য, নৃশংস এবং ব্যর্থ প্রয়াস করেছিল সেই নিষ্ঠূরতা থেকে বাদ পড়েনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও। কয়েকিদনের মধ্যে রাজশাহীতে সক্রিয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দূর্বল হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় গ্রহন করতে বাধ্য হয়। তৎকালীন ই.পি.আর রাজশাহীর শহরের নিয়ন্ত্রন নেয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ শহরে প্রবেশ করে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করে। এই ঘাঁটি অপসারণে এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গৌরবময়, গুরুত্বপূর্ণ, সাহসী অবদান রেখেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা। তাদের সরব আন্দোলন বর্বর পাকিস্তানী সেনা সদস্যদের মনে ভীতির উদ্রেক ঘটায়। ঐ পাষান্ডদের বিতাড়িত করে বাংলার মা, মাটি, মানুষকে মুক্ত করতে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বাংলা মায়ের কোলে লুটিয়ে পড়েছিলেন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, অধ্যাপক মীর আক্ষদুল কাউয়ুম, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ ও বাংলার দামাল ছেলেরা।
বিবরণঃ
১৯৭১ সালের সংগঠিত মহন মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাৎ বরনকারী অসংখ্য মহৎ প্রাণ শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীদের গর্বিত আত্মত্যাগ সমুন্নত রাখতে, তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা দিতে এবং তাদের স্মৃতি চির অম্লান রাখতে উদ্যোগ নেয় কতৃপক্ষ। যার ফলশ্রুতিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নির্মিত হয় স্মৃতি ভাস্কর্য “সাবাস বাংলাদেশ”। কতৃপক্ষ সুবিধা মত জায়গা খুঁজতে থাকে। দীর্ঘ দিন পর অবশেষে সিনেট ভবনের দক্ষিনে ভাস্কর্যটি স্থাপনের জন্য জায়গা নির্ধারিত হয়। ভাস্কর্যটি কোন একক প্রচেষ্টার ফসল নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি, শিক্ষক বৃন্দ, ছাত্র-ছাত্রী এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (১৯৮৮-১৯৮৯) অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি জনাব এম আমানুল্লাহ ১৯৯০ সালের ২৬ শে মার্চ ভাস্কর্যটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রূয়ারী প্রখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পী নিতুন কুন্ডূ মহোদয়ের উপস্থাপনায় এবং বিশ্ববিদ্যলয়ের তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের উদ্যোগে ভাস্কর্যটির নির্মান কাজ শুরু হয়। শিল্পী নিতুন কুন্ডূর এক বছর কঠোর পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে নির্মিত হয় ভাস্কর্যটি। উল্লেখ্য এটি নির্মানে শিল্পী নিতুন কুন্ডূ কোন পারিশ্রমিক গ্রহন করেননি। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি তিনটি বেদির উপর স্থাপিত। প্রথমটি ৪০ ফুট বর্গাকার এবং ভূমি থেকে ৪ ফুট উঁচু। ৬ ফুট উচ্চতার দ্বিতীয় বেদিটিতে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এটিই ভাস্কর্যের প্রধান আর্কষনের বিষয়। এই দুই মুক্তিযোদ্ধার পিছনে আছে ৩৬ ফুট উঁচু বাংলাদেশের পতাকার প্রতিরুপ। নির্মান কাজ সমাপ্তির পর ১৯৯২ সালের ১০ ফেব্রূয়ারী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ভাস্কর্যটির ফলক উন্মোচন করেন। রাজশাহী নাটোর হাইওয়ে থেকে মাত্র ২০০ ফুট দূরত্বে এর অবস্থান। এর স্থাপত্য সৌন্দর্য খুব সহজেই দেশী বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
ভাস্কর্যটিতে স্থান পেয়েছে তারুন্যের জয়গানে মুখর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি লাইন….
“সাবাস বাংলাদেশ
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।”
Source Link1