ঈশ্বর গুপ্ত বলেছেন, “ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙ্গালি সকল” মাছের প্রতি এই ভালোবাসার কারণে প্রাচীন কাল থেকেই বাঙ্গালিদের মাছ খেকো বাঙ্গালি বলা হতো। মাছ বাঙ্গালিদের কাছে অনেক প্রিয় হবার জন্যই বাঙ্গালি গৃহিনীরা বিশেষ যত্ন দিয়ে নানাভাবে মাছ রান্না করতেন। মাংস খাওয়া বাঙ্গালি সমাজে বিশেষ জনপ্রিয় ছিল না, কিন্তু সমাজের নিচের তলায় শামুক, কাঁকড়া, মোরগ হাঁস এবং নানা রকমের পাখির মাংস বেশ চালু ছিল। হিন্দু বিধবাদের মাছ মাংস খাওয়ার ব্যাপারে বাছবিচার থাকায় সেকালের গৃহিণীরা সব্জি রান্নায় বিশেষ বৈচিত্র এনেছিলেন তাছাড়াও নানারকম মিষ্টি, সন্দেশ, চিড়া, মুড়ি, খৈ, নানারকম পিঠা-পায়েশ এগুলো বাঙ্গালির নিজস্ব খাবার। বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমনের ফলে মধ্যযুগের বাঙ্গালি সমাজের একাংশে নতুন ধরনের খাবারের রীতি চালু হয়েছিল। নতুন খাদ্য উপাদানও আমদানি হয়েছিল। ফলে বাঙ্গালিদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তনের বীজ রোপিত হয়। এরপর বাংলায় একে একে পর্তুগীজ ও ইংরেজদের আগমন ঘটলে নতুন নতুন খাদ্য সংযোজন হয় বাঙ্গালির খাদ্য তালিকায়।

ইংরেজ আমলে নিষিদ্ধ খাবার অথবা পরিবারের অপ্রচলিত খাবার তরুণদের মধ্যে বেশি প্রচলিত হবার কারণে ইংরেজ ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে বাংলায় প্রথমবারের মতো রেস্টুরেন্ট খোলা হয়। এভাবেই বাঙ্গালি সমাজে একটা রেস্টুরেন্ট কালচারের সূচনা হয়। বাড়িতে যেসব নিষিদ্ধ খাবার পাওয়া যেত না তরুণেরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে সে সব খাবার খেতেন। কলকাতার এসব রেস্টুরেন্টে ইংরেজ বাবুর্চিরা রান্না করত তবে পরে মুসলমান বাবুর্চিরাও রান্নার কাজে যোগদেন। সেই থেকে মুসলমানদের মধ্যে পেশাদার বাবুর্চি শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। চপ-কটলেট, মুরগি-মাটন সবই তারা রান্না করতেন আবার বিস্কুট পাউরুটিও তৈরী করতেন। এই বাবুর্চিরা যে শুধু ইংরেজি রান্না করতেন তা কিন্তু নয় এসব রান্নার পাশাপাশি তারা নানারকম মোগলাই খাবার রান্না শুরু করেন যেমন কাবাব, কোর্মা, পোলাও, বিরিয়ানী ইত্যাদি।বস্তুত আঠার এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকে মোগলাই খাবার সীমাবদ্ধ ছিল প্রথমে সুবেদার, নবাব, আমীর –ওমরাহ তার পরে অভিজাত শ্রেণির বাঙ্গালি মুসলমানদের মধ্যে। কলকাতার রেস্টুরেন্টে মোগলাই চালু হবার পর তা কলকাতায় অল্পমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। বিশ শতকের দিকে মোগলাই খাবার মুসলমান মধ্য-বিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরে। পাকিস্তান গঠনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানেও মোগলাই খাবার চালু হয়। ১৯৭০ অথবা ৮০-র দশকের প্রথমদিকে যারা বৃত্তি নিয়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিতে গিয়েছিলেন প্রধানত তাদের ছেলেমেয়েরা সে সব দেশে যেসব খাবারের স্বাদ পেয়েছিলো দেশে ফিরেও তার সন্ধান করতে থাকে সে সব খাবার। সেই চাহিদা থেকেই ঢাকা ও কলকাতায় এসব বিদেশী খাবারের নিম্ন মানের রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠে। তবুও নামের মোহে বাঙ্গালি তরুণেরা হ্যাম বার্গার, হটডগ ইত্যাদি কিনতেন। কালের বিবর্তনের সাথে সাথে বর্তমানে বাঙ্গালি সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতি।

তবুও, পোশাক এবং আর পাঁচটা জিনিসের মতো বাঙ্গালির খাবারের উপর নানা সময় নানাধরনের প্রভাব পড়লেও ডাল-ভাত-মাছ-শাক-শুক্তো, কাসুন্দি আচারের মতো খাবারগুলো এখনও বাঙ্গালির।

[সুত্রঃ হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ]