বাঙালির ইতিহাসের সাথে মিশে আছে তার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, গৌরব ও বৈচিত্রতা। এ দেশের জনপদ ছিল সংস্কৃতি মনা যার প্রমাণ মেলে বিভিন্ন গবেষণা ও বর্তমান বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান এর মধ্য দিয়ে। পৃথক পৃথক অঞ্চল এর ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি এর মধ্যে যোগ করেছে বৈচিত্রতা। অঞ্চলভেদে ইতিহাস ও কিছুটা ভিন্ন। তেমনি রাজশাহী অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ছিল আর পাঁচটি অঞ্চল থেকে ভিন্ন। রাজশাহী এর ঐতিহ্য এর অন্যতম একটি নিদর্শন ঢোপকল। রাজশাহীর সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে এ ঢোপকল এর সাথে।
ঢোপকল এর ইতিহাস ও পরিচয়:
রাণী হেমন্ত কুমারী এর আর্থিক সহায়তা ও প্রচেষ্টার ফলে এ এলাকার মানুষ এর সার্বক্ষণিক বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রায় ১০০ এর অধিক ঢোপকল বসানো হয়। ১৯৩৭ সালে ঢোপকল বসানোর এ উদ্যোগ শুরু হয়। তবে পরিতাপের বিষয় এই যে বর্তমানে এএকটিমাত্র ঢোপকল এ ঐতিহ্যের স্বাক্ষী হয়ে আছে। ঢোপকল মূলত সে আমল এর নির্মিত পানির কুয়া। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে রাজশাহী অঞ্চলে পানির অভাব দেখা দেয়া শুরু করে। খাবার বিশুদ্ধ পানির অভাবে এ অঞ্চলে কলেরা আমাশয় এর মত বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। এ সমস্যা সমাধান তখন সময়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৯৩৭ সালে রাণী হেমন্ত কুমারী এবং রাজশাহী এর ধনী ব্যক্তিদের সহায়তায় নগড়জুড়ে তৈরী করা হয় ঢোপকলগুলো। আজ কালের বিবর্তনে এ ঢোপকল হেমন্তকুমারী ঢোপকল নামে পরিচিত।
গঠন বৈশিষ্ট্য:
ঢোপকল গুলো ভূমি থেকে ১২ ফুট উঁচুতে ৪ ফিট জায়গা জুড়ে অবস্থান করতো। সিমেন্ট এর শক্ত ঢালাই দিয়ে তৈরী করা এ ঢোপকল গুলো ছিল বেশ মজবুত যা যেকোনো বড় দুর্ঘটনা ছাড়া ভাঙা সম্ভব ছিল না। এ ঢোপকল গুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা ও ছিল চমৎকার। ঢোপকলগুলোর মুখ থেকে ভেতরে প্রবেশ করে তা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধোয়া হতো এর পাশাপাশি পানির গুনগত মান নিশ্চিত করতে, ২ মাস পর পর পানি পরীক্ষা করা হতো। ঢোপকল গুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা ছিল প্রায় ৪৭০ গ্যালন। একটি রাফিং ফিল্টার থাকতো প্রতিটি ঢোপকলে যা সরবরাহকৃত পানি কে আরো বিশুদ্ধ করতো এবং পানির গুনগত মান ঠিক রাখতো। সারাদিনে মোট ২ ঘন্টা পানি সরবরাহ করা হতো এবং এ সময়ে ঢোপকল গুলোতে পানি সরবরাহ করে রাখা হতো ফলে পানির কোনো অভাব দেখা দেয় নি।
রাজশাহী শহরের সভ্যতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা ও ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকা এ ঢোপকল এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হৃাস পাচ্ছে। শহরের কুমারপাড়া, ফায়ারবব্রিগেড এর মোড়, বেলদাড়পাড়া সহ হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি স্থানে স্মৃতি হিসেবে রয়েছে এ ঢোপকলগুো। এভাবে রাজশাহী এর প্রাচীন ঐতিহ্য এর সাথে মিশে থাকা ঢোপকল আজ বিলুপ্তির পথে। গোটা শহর জুড়ে রয়েছে মাত্র ১-২ টি ঢোপকল যেগুলো ও উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবে আজ বিপন্ন প্রায়। কর্তৃপক্ষ এ উদাসীনতা দেখালে ও ইদানিংকালে এ ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ বেশ সচেতন ও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ঢোপকল গুলো সংরক্ষণ এর জন্যে একে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে যা আদতে একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নয়। ঢোপকল গুলো থাকায় এখনো নগরীর অনেক গরিব মানুষ উপকৃত হচ্ছে। তবে, ঢোপকলগুলো কে এখনো ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সংস্কার, অপসারণ নয়। এগুলো কে সংস্কার ও পরিচর্যার মাধ্যমে ঐতিহ্য কে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি জনস্বার্থে ব্যবহার করা ও সম্ভব।
কালের বিবর্তন এর সাথে সাথে রাজশাহী অঞ্চল এর ইতিহাস এর ধারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢোপকলগুলো। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এ ধারক কে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করার কার্যক্রম চলছে। যার ফলে, রাজশাহী এর ইতিহাসের ধারক হয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ও টিকে থাকবে এ সভ্যতা ও ঐতিহ্যের ধারক ঢোপকল।
Source Link1 | Link2 | Link3 | Link4 | Link5 | Link6 | Link7
thanks