আঠারো শতকে নির্মিত দিঘাপাতিয়া মহারাজাদের বাসস্থান। দয়ারাম রায় (১৬৮০-১৭৬০) এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। নাটোর শহর থেকে প্রায় ২.৪ কিলোমিটার দূরে প্রাসাদটির অবস্থান। প্রায় তিনশ পুরানো ঐতিহাসিক দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি বর্তমানে নাটোরের উত্তরা গণভবন নামে অধিক পরিচিত। এখন এটি ব্যবহৃত হয় উত্তরা গণভবন বা উত্তরাঞ্চলের গভর্নমেন্ট হাউজ হিসাবে।

ইতিহাসঃ

রাজা দয়ারাম রায় তাঁর রাজত্বকালে প্রাসাদের মূল ভবনসহ বেশ কিছু ভবন নির্মান করেছিলেন। ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায়ের শাষন আমলে ১৮৯৭ সালে এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে প্রাসাদটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। রাজা প্রমদানাথ রায় বিদেশী বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, চিত্রকর্ম শিল্পী এবং দেশীয় মিস্ত্রীদের সহযোগীতায় ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ বছর রাজ বাড়ি পূনঃনির্মান করেন।

প্রায় ৪১ একর জমির প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদটি একটি পরিখা ও উঁচু প্রচীর বেষ্ঠিত। পূর্ব পাশের প্রবেশ দ্বারটি চারতলা বিশিষ্ট পিরামিড আকৃতির। উপরের দিকে সরু হয়ে একটি ঘড়ি যুক্ত টাওয়ারে শেষ হয়েছে। ঘড়িটির পাশে রয়েছে বিশাল একটি ঘন্টা। এক সময় এ ঘন্টার ধ্বনি বহুদূর থেকে শোনা যেত।

ইংরেজি ‘ই’ অক্ষরের আদলে নির্মিত প্রাসাদটির সামনের দিকে তিনটি বারান্দা। প্রাসাদের সমস্ত দেওয়াল জুড়ে রয়েছে ফুল পাতার নয়নাভিরাম নকশা। প্রাসাদের মূল ভবনে রয়েছে নয়টি সুসজ্জিত শয়ন কক্ষ, একটি অভ্যর্থনা হল, একটি ডাইনিং হল ও একটি সম্মেলন কক্ষ। সিলিং, দেওয়াল এবং মেঝেতেও শোভা পাচ্ছে ফুলের নকশা। প্রাসাদ থেকে মূল্যবান অনেক দ্রব্যাদি লুন্ঠিত হলেও এখন অবশিষ্ট দ্রব্যগুলোই আর্কষনের কেন্দ্রবিন্দু। প্রাসাদে আছে সুদীর্ঘ প্রবেশ পথ। পথের শোভা বর্ধনের জন্য দুপাশে লাগানো আছে পাম ট্রি।

প্রাসাদটির ভিতরে আছে বহু প্রাচীন ও দূর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ ব্রাউনিয়া ও ককেসিয়া। এছাড়াও এখানে আছে রাজ-অশোক, পারিজাত, সৌরভী, কর্পূর, হরিতকী,হাপাবমালি, যষ্টিমধু, তারাঝরা, নীলমনিলতা, হৈমন্তীসহ বিভিন্ন দূর্লভ প্রজাতির ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষ। ভিতরে আরও রয়েছে বিশাল মাঠ, গোলাপ বাগান ও গণপূর্ত অফিস।

দ্বিতল হলুদ ভবনটি কুমার প্যালেস, যার নিচতলা টর্চার সেল নামে পরিচত। ১৭৯৯ সালে স্থাপিত কামানগুলো এখনও প্রাসাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। রাজদরবার সংলগ্ন বাগানে প্রতিষ্ঠিত আছে রাজা দয়ারাম রায়ের ভাস্কর্য। প্রাসাদের মধ্যে আরও দুইটি ভবন আছে। গাড়ি পার্ক করার জন্য আলাদা গ্যারেজ আছে। ভবনের মধ্যে রয়েছে জাদুঘর, স্মৃতিস্তম্ভ, ভাস্কর্য ও দৃষ্টি নন্দন স্থাপত্য।

সবচেয়ে আর্কষনীয় অংশ হল ইতালিয়ান গার্ডেন। রাজা দয়ারাম রায় এই গার্ডেনের আসবাবপত্র সুদুর ইতালি থেকে আনিয়েছিলেন। ছিপ হাতে মার্বেল পাথরের মুর্তিটি অসাধারন। স্বর্ণ দিয়ে কব্জি বাঁধাই করা একহাত ভাঙা পাহাড়ী কন্যার পাথুরে মুর্তিটি খুবই সুন্দর। রাণির টী হাউজও অতুলনীয়।

এখানে ছয়টি বাহারী নামের পুকুর আছে- গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, কাছারিপুকুর, কালীপুকুর, কেষ্টজির পুকুর ও শ্যামসাগর। সংস্কারের অভাবে পুকুরগুলো তাদের ষৌবন হারিয়েছে। একসময় পুকুর গুলো বেশ আর্কষনীয় ছিল। ভাঙাচোরা একাধিক ঘাট গুলো তারই স্বাক্ষ্য বহন করে।

সুরম্য প্রাসাদ ঘিরে লাগানো ছিল আম, জাম, কাঁঠাল, লেবু, লিচু, কদম, পাম, চন্দন, সেগুন, মেহগনিসহ হাজারো গাছ, যার বেশির ভাগ বিলুপ্তির দ্বার প্রান্তে।
রাজপ্রাসাদের পিছনে রয়েছে ফোয়ারাসহ সুদৃশ্য এক বাগান। বাগানের এক কোণে রয়েছে মার্বেল পাথরে নির্মত এক অসাধারণ নারী মূর্তি।

নামকরনঃ

দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে দিঘাপতিয়া রাজা ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হয়। ফলে রাজপ্রাসাদটি সংরক্ষণে সমস্যা শুরু হয়। সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর আবদুল মোনায়েম খান। তিনি ১৯৬৭ সলের ২৪ জুলাই প্রাসাদকে দিঘাপতিয়ার গর্ভনরের বাস ভবন হিসাবে উদ্বোধন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ০৯ ফেব্রূয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এই গর্ভনর হাউজের মূল ভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠক আহবান করেন এবং এটিকে উত্তরা গণভবন হিসাবে ঘোষনা করেন। সেই থেকে প্রাসাদটি উত্তরা গণভবনের মর্যাদালাভ করে।

বর্তমানে উত্তরা গণভবনটি জনসাধারনের জন্য উম্নুক্ত। নাটোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে দর্শনার্থীরা প্রাসাদটির সৌন্দয্য উপভোগ করতে পারেন। ভবনটি আমাদের অতীত ইতিহাস, অহংকার ও গর্ব স্মরনের দাবিতে উজ্জ্বল।

Source Link1 | Link2