কাঁচা নয়, গোলও নয়- কিন্তু নাম তার কাঁচাগোল্লা! রাজশাহীর বিখ্যাত কাঁচাগোল্লার নাম শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সবাই জানে এটা একটা সুস্বাদু মিষ্টি। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও রয়েছে এর ব্যাপক কদর। আনুমানিক ২৫০ বছর আগে বৃহত্তর রাজশাহীর নাটোর শহরের লাল বাজারের মধুসূদন পালের মিষ্টির দোকানে ভুলক্রমে জন্ম নেয় এই মিষ্টি! তারপর শুরু হয় কাঁচাগোল্লার গৌরবময় পথ চলা।

শুরুর কথাঃ

কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এক চমৎকার কাহিনী। প্রায় ১৭৫৭ সালের কথা। লাল বাজারের মিষ্টির দোকানদার মধুসূদন পালের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়। কারণ সেদিন তার দোকানের বেশির ভাগ কর্মচারীই আসেনি। এতো ছানা কী হবে? ভেবেই কূল কিনারা পাচ্ছিলেন না তিনি। হটাৎ মাথায় এলো এক অভিনব বুদ্ধি। তিনি কর্মচারীদের ছানাতে চিনির রস মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বললেন। চিনি মিশ্রিত ঐ ছানা মুখে দিয়ে দোকানদার তো হতবাক! এটা কী তৈরি হয়েছে? নামহীন অপূর্ব সুস্বাদু এক মিষ্টি!

নামকরনঃ

কাঁচা ছানা চিনির রসে ঢেলে এই মিষ্টি তৈরি হয়েছিল বলে তাৎক্ষনিক ভাবে এর নাম রাখা হয় কাঁচাগোল্লা। ধীরে ধীরে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়ায়। জনসমাগম বাড়তে থাকে মধুসূদন বাবুর মিষ্টির দোকানে। তখন থেকে তিনি তার দোকানে নিয়মিত কাঁচাগোল্লা বানাতে থাকেন। জনশ্রুতি আছে, সেই সময় হাটে-বাজারে বা লোকালয়ে ঢোল পিটিয়ে জানানো হতো কাঁচাগোল্লার কথা।

তৈরির কৌশলঃ

কাঁচাগোল্লা তৈরির উপকরণগুলো হচ্ছে ছানা, চিনি ও এলাচ। এক কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে প্রায় এক কেজি ছানা ও চারশত গ্রাম চিনির প্রয়োজন। কড়াইয়ে পানি নিয়ে প্রয়োজন মতো চিনি দিয়ে জ্বাল দিতে হয়। চিনি পরিষ্কার করতে অল্প পরিমান কাঁচা দুধ দিতে হয়। কড়াইয়ের গাদ-ময়লা পরিস্কার হয়ে গেলে ছানা ঢেলে নাড়তে হয়। এভাবে ৩০-৪০ মিনিট নাড়তে নাড়তে কাঙ্খিত কাঁচাগোল্লা তৈরি হয়ে যায়। তবে এই নাড়াচাড়ার মাঝেই রয়েছে শৈল্পিক কারুকাজ। আসল কাঁচাগোল্লার স্বাদ পেতে এলাচ ব্যবহার করা হয় না।

প্রাপ্তিস্থানঃ

রাজশাহীসহ বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের মিষ্টির দোকানগুলোতে এই কাঁচাগোল্লার সরব উপস্থিতি। সব দোকান মালিকরা নিজেদের মিষ্টি স্বাদে-গন্ধে আসল ও এক নম্বর হিসাবে দাবি করেন। এজন্য সাধারণ ক্রেতারা দ্বিধায় পড়তে বাধ্য। তবে বতমানে মানসম্নত কাঁচাগোল্লা বিক্রিতে সুনাম অর্জন করেছে নিচবাজারের মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডার ও বড় হরিশপুর মোড়ের গ্রিন ফুড গার্ডেন। এছাড়া লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান, নিচবাজারের কুন্ডু মিষ্টান্ন ভান্ডার, অনুকূল দধি ও মিষ্টান্ন ভান্ডার, স্টেশন বাজরের নয়ন এবং সকাল-সন্ধ্যা হোটেলেও ভাল মানের কাঁচাগোল্লা পাওয়া যায়।

দেশ বিদেশে কাঁচাগোল্লাঃ

বাংলায় প্রাপ্ত মিষ্টিসমূহের মধ্যে কাঁচাগোল্লার অবস্থান ছিল সবার উপরে। তাই দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি। যেটার শুভ সূচনা হয়েছিলো অর্ধবঙ্গেশ্বরী, বাংলার দানশীলা শাষণ কর্তা রানী ভবানীর রাজত্বকাল থেকেই কাঁচাগোল্লা ভ্রমন করেছে সমগ্র ভারতবর্ষ। অানাগোনা ছিলো বিলেতের রাজপরিবারেও। শোনা যায় রানি ভিক্টোরিয়াও এর স্বাদ আস্বাদন থেকে বিরত হননি। রাজশাহীর গেজেট পত্রিকাসহ কোলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি ও গুণাগুণ নিয়ে হয়েছে বিস্তর লেখালিখি। এভাবেই কাঁচাগোল্লার স্বাদের কথা ভারত, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। কাঁচাগোল্লা পায় আর্ন্তজাতিকতা।

দরদামঃ

জনশ্রুতি আছে এক সময় প্রতি সের কাঁচাগোল্লার মূল্য ছিল তিন আনা, স্বাভাবিকভাবেই এখন তা ইতিহাস। কিছুদিন আগেও ১৮০-১৯০ টাকা দরে বিক্রি হতো কাঁচাগোল্লা। বর্তমানে এর দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এখন এর বাজার দর প্রায় ৪০০ টাকা।

অসুবিধাঃ

কাঁচাগোল্লার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভেজাল কাঁচাগোল্লা তৈরি করে বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করছে। এতে জন সাধারণ প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে। এখনি সময় এসব বন্ধ করার। তা না হলে রাজশাহীর এই জনপ্রিয় মিষ্টির নাম বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির তালিকা থেকে হারিয়ে যাবে। রাজশাহীর সচেতন মহলের ধারনা কাঁচাগোল্লার ভেজাল ব্যবসা বন্ধ না হলে প্রকৃত কাঁচাগোল্লার সুনাম নষ্ট হবে এবং প্রকৃত মিষ্টি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লার স্বাদ ও মান ঠিক রাখতে এবং ভেজাল কাঁচাগোল্লা তৈরির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন সময় ভ্রম্যমান আদালত পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু ফলাফল প্রায় শূণ্যের কোঠায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সজাগ দৃষ্টি, অসাধু ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন ও মূল্যবোধের উন্নয়ন। আর এ ব্যাপারে গুরুত্বরপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে রাজশাহীসহ সারা দেশের জনগন।