সবুজ ঘাসে ঢেকে থাকা বিরাট একটি মাঠের দক্ষিণে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ধ্বংসের প্রহর গুনছে যে বিশাল স্থাপনাটি, এটিই বিখ্যাত সেই পুঠিয়া রাজবাড়ি। মহারানি হেমন্তকুমারী দেবী ১৮৯৫ সালে এটি নির্মাণ করেছিলেন তাঁর শাশুড়ি শরৎসুন্দরী দেবীকে সম্মান প্রদর্শনে। এ ভবনের পূর্ব দিকে রয়েছে রানি পুকুর। এ বাড়ির সম্ভ্রান্ত মহিলাদের গোসল করার উদ্দেশ্যে নির্মিত পুকুরটির দেয়াল ঘিরে সান বাধানো ঘাট আজো তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে চলছে। পুঠিয়া রাজবাড়ির এই বিশাল চত্বরে আছে অনেকগুলো প্রাচীন মন্দির। আরো ভাল করে বলতে গেলে, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মন্দিরগুলোর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি সংখ্যক ই রয়েছে পুঠিয়া মন্দির চত্বরে। এখানকার বিখ্যাত রাজ পরিবারে হিন্দু জমিদার-রাজারা ছিলেন জনহিতৈষী। তাঁরাই এই নজরকাড়া মন্দিরগুলো প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলোর মধ্যে রয়েছে পাঁচ আনি বড় শিব মন্দির, গোবিন্দ মন্দির, আহ্নিক মন্দির, দোলমন্দির, রথমন্দির, চারআনি গোবিন্দ মন্দির, চারআনি শিব মন্দির, চারআনি আহ্নিক মন্দির, চারআনি গোপাল মন্দির, কৃষ্ণপুরের শিবমন্দির ও বনদূর্গারদ মন্দির। শুধু কি মন্দির? এখানে আরও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন স্থপনা।
এখানকার বেশ কিছু মন্দির টেরাকোটা সম্বলিত। এই মন্দিরগুলোতে জোড় বাংলা স্থাপত্য শৈলী লক্ষ্য করা যায়। ইন্দো-সারাসেনিক নির্মাণশৈলী অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছিল পুঠিয়ার বিখ্যাত রাজবাড়িটি। এই পুঠিয়া মন্দির চত্বরের মন্দিরগুলো তৈরি করা হয়েছে একটি বিরাট জলাধার বা লেকের চারপাশজুরে। মন্দিরগুলোর ঠিক মাঝখানে আপনি একটি সবুজ চত্বরও দেখতে পাবেন।
রাজবাড়ির ইতিহাস
এখানকার জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা পিতাম্বর। কিন্তু লস্করী খান ছিলেন এই প্রাচীন এলাকার ভূপতি। সম্রাট আকবরের শাসনামলে যখন লস্করী খান বিদ্রোহী হয়ে উঠেন, তখন সেনাপতি মানসিংহ পিতাম্বরের হাতে এ এলাকার শাসনভার তুলে দেন। এ পুঠিয়া রাজবংশের হাতে ছিল ব্রিটিশ-বাংলার ২য় বৃহত্তম জমিদারী এবং সম্পদের দিক হতে ব্রিটিশ-বাংলার সর্বাপেক্ষা ধনী ছিলেন তাঁরা। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার বিলুপ্ত করে এ জমিদারী প্রথা। শুধু তাই নয়, জমিদারীর সকল সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করে তাঁরা। আর তখনই ভারতে চলে যায় পুঠিয়া রাজবংশ। আর এর কিছু পর থেকেই পুঠিয়া মন্দির চত্বর বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
কীভাবে যাবেন
রাজশাহী-নাটোর হাইওয়ের পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ড হতে মাত্র ১ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত এই রাজবাড়ি। আপনি রিকশায় গেলে মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবেন আপনার গন্তব্যে। রিকশায় গেলে ভাড়া দিতে হবে মাত্র ৫ টাকা। নাটোর শহর হতে সড়ক পথে দূরত্ব মাত্র ১৮ কি.মি. এবং রাজশাহী থেকে দুরত্ব মাত্র ৩৪ কি.মি.।
যদি নিজস্ব গাড়িতে করে যান, রাজশাহী সিটির প্রায় ৩০ কি.মি. আগেই পাবেন স্থানটি। তাছাড়া আপনি যেকোনো রাজশাহীগামী বাসে করেও পুঠিয়া গিয়ে নামতে পারেন। আপনি যদি রাজশাহী শহর হতে কোনো লোকাল বাসে পুঠিয়ায় আসেন, সময় লাগবে কমবেশি পৌনে ১ ঘণ্টা। রাজশাহীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল হতে যেকোনো নাটোরগামী বাসে করে পুঠিয়াতে এসে নামতে পারেন আপনি।
কোথায় থাকবেন
পুঠিয়ায় জেলা পরিষদের ২টি ডাকবাংলো আছে এবং আপনি সেখানে নির্ধারিত ভাড়া দিয়ে থাকতে পারবেন। যাহোক, আপনি আসার পূর্বেই জেলা পরিষদ থেকে রুম বরাদ্দ নিতে হবে এখানে। সেজন্য আসার আগেই জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে নেবেন। পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছেই একটি আবাসিক হোটেল আছে।
এছাড়া আপনি রাজশাহী শহরেও থাকতে পারেন। এখানে থাকার জন্য অনেকগুলো হোটেল আছে ভিন্ন ভিন্ন মানের। এদের মধ্যে মোটামুটি মান সম্পন্ন হচ্ছে রাজশাহী চিড়িয়াখানার কাছে পর্যটন মোটেল, বিন্দুরমোড়ের রেল গেইটে আছে হোটেল ডালাস ইন্টারন্যাশনাল, লক্ষ্মীপুর মোড়ের হোটেল গ্যালাক্সি, গণকপাড়ার হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল, সাহেব বাজারের হোটেল মুক্তা ইন্টারন্যাশনাল, হামিদিয়া গ্রান্ড হোটেল, হোটেল নিউ টাউন ইন্টারন্যাশনাল এবং মালোপাড়ার হোটেল সুকর্ণা ইন্টারন্যাশনাল, প্রভৃতি।
ইতিহাস বিজড়িত পুঠিয়া মন্দির চত্বর ভ্রমন আপনার শুভ হোক।