পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের রাজশাহী বিভাগের ৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিভাগীয় শহর হচ্ছে রাজশাহী। প্রাচীন বাংলার লক্ষণৌতি বা লক্ষনাবতি, পুন্ড্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য শহর ছাড়াও রাজশাহী তার আকর্ষণীয় রেশমীবস্ত্র, আম, লিচু এবং মিস্টান্নসামগ্রীর জন্য প্রসিদ্ধ। রেশমীবস্ত্রের কারণে রাজশাহীকে রেশমীনগরী বলে আখ্যায়িত করা হয়। তবে এশিয়ার অন্যান্য সব জায়গার মত রাজশাহী তেও গ্রীষ্মের সময়ে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে যায়। মাঠ এবং রাস্তার ধূলোবালি, শহরের প্রান্তে ইটের ভান্ডারের ধোঁয়া, বিভিন্ন বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক গ্যাস ও কণা ইত্যাদি জিনিস দিয়ে এসব শহরের বায়ু দূষিত থাকে সবসময়। তবে হটাত করে রাজশাহী শহরের বায়ুতে এমন এক পরিবর্তন আসে যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দেয়। যুক্তরাজ্যের দা গার্ডিয়ান পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী শহরের বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক ভাসমান পিএম১০ কণা কমে এসেছে রেকর্ড পরিমাণে। বিশ্বের অন্য সব নামীদামী শহরের চেয়ে রাজশাহী শহর তার জনগণকে নির্মল বায়ু এবং পরিবেশ উপহার দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে।
❖এই পরিবর্তনের কারণঃ
যদিও রাজশাহী শহরের বড় কোন বাণিজ্যিক এলাকা নেই তবুও এই শহরের বায়ুতে এত বড় পরিবর্তন আসার কারণ হচ্ছে ১৫ বছর আগের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী এবং সেই সাথে পরিবহণ ব্যবহার করে শহরের সব ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করার কারণে। শহরটিকে গত কয়েক বছরে যে পরিমাণে সবুজ গাছগাছালি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে সেটা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। বৃহত্তর পিএম১০ কণার মাত্রা ২০১২ সালে প্রতি ঘন মিটারে 195 মাইক্রোগ্রাম থেকে ২০১৬ সালে মাত্র ৬৩.৯ মাত্রায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে যা বিশ্বের অন্যান্য শহরের চেয়ে অনেক বেশি। ছোট পিএম২.৫ কণা ৭০ থেকে প্রায় ৩৭ মাইক্রোগ্রাম নেমে প্রতি ঘন মিটার থেকে অর্ধেক হয়েছে। এত বড় একটি পরিবর্তনের পেছনে রাজশাহী শহরের সবুজায়ন এবং শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নেয়া সকল প্রকল্প অনেক প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখছে।
❖অতীতের কিছু কথাঃ
অতীতে এমন ও সময় ছিল যখন রাজশাহীর বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ এত বেশি পরিমাণে ছিল যে, যখন ই বাইরে বাতাস বইত, সবাইকে নিজের ঘরের জানালা গুলো বন্ধ করে দিতে হত যাতে ঘরের মধ্যে ক্ষতিকর এবং ধূলা যুক্ত বাতাস না ঢুকতে পারে। কিছু কিছু সময় এখনও শহরের বায়ুতে ধূলিকণা পাওয়া যায় কিন্তু এই পরিবর্তন শহরের বাসিন্দারা স্বাগতম জানিয়েছে এবং তারা এই ব্যাপারে অনেক খুশি যে তাদের শহর এখন নির্মল বায়ুতে পরিপূর্ণ।
❖বর্তমানের চিত্রঃ
বর্তমানে শহরের অভ্যন্তরীণ অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। শহরটিকে সবুজ গাছগাছালি দিয়ে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। নগরীর প্রধান সড়ক বিভাজক ও সড়ক দ্বীপে ২০ ফুট অন্তর লাগানো হয়েছে ৩৫০টি পামগাছ। এই গাছগুলোর ভেতরে লাগানো হয়েছে রঙ্গন, কাঠ করবি, চেরি ও এ্যালামুন্ডা। সবার নিচে সবুজ হেজ লাগিয়ে আরও সুন্দর করা হয়েছে প্রতিটি গাছের আশেপাশের পরিবেশ। এরপর কাঠ ও বাঁশের আদলে কনক্রিটের বেড়া তৈরি করে মজবুতভাবে এগুলোকে রেখে দেয়া হয়েছে যাতে সহজেই নষ্ট না হয়। এই সবকিছু মিলিয়ে পুরো রাজশাহী শহর এখন বাংলাদেশের অন্য সব শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম সুন্দর নগরী হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা রাজশাহী শহরের এই পরিবর্তন নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। বাতাসের নির্মল পরিবেশ এবং এই দৃষ্টি নন্দনীয় সাজানো সবকিছু তাদেরকে রাজশাহী শহরের প্রতি অনেক ইতিবাচক মনোভাব এনে দিয়েছে।
❖এই বড় অর্জনের কারণঃ
২০০৪ সাল থেকে রাজশাহী শহরের নগর কর্তৃপক্ষরা তাদের পরিবহণ সমস্যা মোকাবেলা করা শুরু করে। তারা চীন থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি করে এবং দিনের বেলায় শহরে বড় ট্রাক এবং এ জাতীয় যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করে। তিনচাকার পরিবহনগুলো বাতাসকে পেট্রোল এবং ডিজেলের ধোঁয়া মুক্ত রাখে। ইটের ভাটা গুলোতে চেম্বার এবং জ্বালানী পরিবর্তনের মত উন্নতিগুলোর কারণে এগুলো বাতাসে ক্ষতিকর কণা তেমনভাবে আগের মত আর ছড়াতে পারে না। ধূলোর পরিমাণ হ্রাস করতে বিভিন্ন প্রকল্প তত্ত্বাবধান করা হচ্ছে যাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাজশাহীর এই উন্নতি আরও অনেক বেশি পরিমাণে বেড়ে যায়। জিরো সয়েল প্রকল্প এবং অন্যান্য প্রকল্পগুলোর কারণে এখন রাজশাহীর বায়ুদূষণ অনেক বেশি পরিমাণে কমে গিয়েছে। যখন এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হবে তখন পুরো রাজশাহী শহর সবুজ গাছ দিয়ে ভরে যাবে এবং পুরো শহরটিকে অনেক সুন্দরভাবে বহির্বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করা যাবে।
রাজশাহী শহর দিন দিন পরিবেশ দূষণ থেকে যতই মুক্তি পাচ্ছে, বিশ্বের কাছে এই শহরের নাম ততই উপরে উঠছে। বাংলাদেশের অন্য নগরীগুলোতেও যদি এভাবে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া যায় তাহলে পুরো দেশটিকেই একদিন নির্মল বায়ুতে পরিপূর্ণ করে তোলা সম্ভব। আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই বিষয়টি নিয়ে অতিসত্বর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।