একজন শিক্ষাবিদ এবং ছাত্রবান্ধব অধ্যাপক- শহীদ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা হলেন বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী।
মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিম বঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় ১৯৩৪ সালের ১লা মে। তাঁর বাবার নাম ছিল মোহম্মদ আব্দুর রশিদ। আব্দুর রশিদ একজন সাধারণ চাকুরীজীবী ছিলেন। শামসুজ্জোহা ছিলেন বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। তিনি বাঁকুড়াতেই পড়ালেখা করেন। বাঁকুড়া জেলা স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে তৎকালীন ম্যাট্রিক পরীক্ষা ও ১৯৫০ সালে বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। এদিকে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর প্রায়শই দাঙ্গা লাগায় ১৯৫০ সালে শামসুজ্জোহা পূর্ব বাংলায় মানে বর্তমানের বাংলাদেশে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর পাস করার পর তিনি লন্ডনে চলে যান এবং সেখানে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত থাকেন। সেখানে তিনি পড়াশুনা করেন এবং বিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৬১ সাল থেকে শামসুজ্জোহার কর্মজীবন শুরু। যদিও এর আগে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টে অর্ডিন্যান্স কারখানায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের লেকচারার পদে যোগ দেন। মাঝে আবার লন্ডন যান পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের জন্য। ১৯৬৪ সালে ফিরে এসে আবার কাজে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি রীডার পদে উন্নীত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে নিযুক্ত হন এবং সেই পদেই তিনি ছিলেন তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। ১৯৬৮ সালে তিনি নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের বৃত্তি পেলেও পর্যাপ্ত এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ছাড়েনি। ফলে তিনি রাজশাহীতেই থেকে যান।
১৯৬৮ সালে পূর্ব বাংলায় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এবং এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাকিস্তান বাহিনী হত্যা করে। ফলে উত্তপ্ত হয়ে উঠে সারাদেশ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও খেপে উঠে এবং আন্দোলন শুরু করে। ছাত্ররা ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলন ও বিক্ষোভ শুরু করে। এতে ওইদিন অনেক ছাত্র পুলিশের হামলায় আহত হয়। পরদিন ১৮ তারিখ আবার ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে জমা হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এমন সময় পাকিস্তান বাহিনী এসে ছাত্রদের সরিয়ে দিতে চায়। ওইদিন ১৪৪ ধারা জারি ছিল। ছাত্ররা সেই ধারা ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। শামসুজ্জোহা ছাত্রদের কাছে এসে তাদের বোঝাতে অক্ষম হন। এরপর তিনি পাকিস্তান বাহিনীর সাথে কথা বলেন যেন ছাত্রদের উপর কোন হামলা না করা হয়। তিনি তাদের প্রধান ফটক খুলে দিতে বলেন। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনী তাঁর কথা মেনে নিতে অস্বীকার করে। তিনি তখন বলেন তাঁর ছাত্রদের যদি গুলি চালাতে হয় তবে আগে তাঁর গায়ে গুলি চালাতে হবে। পাকিস্তান বাহিনী গুলি চালায় এবং শামসুজ্জোহা গুলিবিদ্ধ হন। এরপর তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচানো হয়। তাঁকে হাসপাতালেও নিতে দেয়া হয়নি। এরপর তাঁকে হাসপাতালে নিলে বিকাল ৩ টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনিই প্রথম বুদ্ধিজীবী শহীদ। তাঁর মৃত্যুর খবরে ছাত্ররা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এবং সমগ্র দেশে বিক্ষোভ চূড়ান্ত রুপ লাভ করে। যার ফলে আইয়ুব সরকারের পতন হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শহীদ শামসুজ্জোহা হল’ তৈরি হয়েছে; ২০১২ সালে এর পাশে শহীদ শামসুজ্জোহা স্মৃতি ভাস্কর্য তথা ‘স্ফুলিঙ্গ’ স্থাপন করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রশাসন ভবনের সামনে একটি চমৎকার চত্তর আর তাঁকে স্মরণ করে তৈরি করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হয়। নাটোরে তাঁর নামে একটি কলেজ আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে “ জোহা সিম্পজিয়াম” পালন করা হয় প্রতি বছর; বাংলাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমাজ তাঁকে মনে করে প্রতিবছর ১৮ই ফেব্রুয়ারি শিক্ষক দিবস পালন করে থাকেন।
তথ্যসূত্রঃ
https://en.wikipedia.org/wiki/Mohammad_Shamsuzzoha
http://en.banglapedia.org/index.php?title=Shamsuzzoha,_Shaheed_Mohammad